গত ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ১০০ দিন পূর্ণ করল আজ, ১৫ নভেম্বর। দেশ পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এই সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
১. আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন
গত ২৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩-এর ৮টি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই আইনকে যুগোপযোগী করতে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়, যেখানে বিশিষ্ট আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, বিচারের মাধ্যমে বিভাজন দূর করে পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই।
২. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কার্যক্রম শুরু
অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেছে। হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতিদের নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় এবং একটি শক্তিশালী প্রসিকিউশন টিম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৩. সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের উদ্যোগ
সাইবার নিরাপত্তা আইন পুরোপুরি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা অতীতে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে ব্যবহার করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা জানান, আইন বাতিল হলে হয়রানিমূলক মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যাহার হবে।
৪. সুপ্রিম কোর্ট ও বিচার বিভাগ সংস্কার
বিচার বিভাগ সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে নতুন বিচারপতি নিয়োগ, বিচারকদের সম্পদের হিসাব দাখিল, এবং অধস্তন আদালতের কর্মচারী নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
৫. গুমবিরোধী সনদ ও তদন্ত কমিশন গঠন
গুম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থন এবং অতীতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান ও বিচার নিশ্চিত করতে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
৬. বিচার ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন
দেশে একটি মডেল ই-কোর্ট এবং সাব-রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপনের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে মামলা পরিচালনা এবং রায় প্রকাশের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
৭. গণআন্দোলনের মামলাগুলো প্রত্যাহার
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে দায়ের করা ফৌজদারি এবং হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মামলাগুলোও প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
৮. ন্যায়পাল অফিস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
সরকারি কাজে স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি রোধে ন্যায়পাল অফিস প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
৯. নতুন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন
সরকার ১০টি অধ্যাদেশ এবং ৯৫টি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক আইন সংশোধন, স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন, এবং জামায়াতসহ নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর ওপর নির্দেশনা।
১০. অবকাঠামো উন্নয়ন
দেশের ২৩টি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন, ৬টি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ভবন, এবং ১০টি জেলা জজ আদালতের ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের কার্যক্রমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার এবং সমাজের বিভাজন দূর করার চেষ্টা দৃশ্যমান। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এই উদ্যোগগুলো দেশের প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।