বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটাপন্ন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি, লুটপাট এবং অর্থ পাচারের কারণে দেশের আর্থিক খাত চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, ডলার সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই কঠিন সময়ে দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে ড. ইউনূস বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য আর্থিক সহায়তা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
বর্তমানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন ড. ইউনূস। সেখানে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইএসডিবি), এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। এসব সহায়তা পেলে দেশের ডলার সংকট ও রিজার্ভের পতন রোধ করে আর্থিক খাতকে পুনর্গঠিত করার সুযোগ তৈরি হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইএমএফ থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও আর্থিক খাতের সংস্কারের শর্তের কারণে অনেকটাই অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দ্রুত ঋণ প্রদানে সম্মত হয়েছে, যা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির কারণেই।
ড. ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবা, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং উইসহ অনেক বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশের আর্থিক চ্যালেঞ্জ এবং পুনর্গঠনের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশকে মোট প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এসেছে। এর মধ্যে ২ বিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ হিসেবে এবং ১.৫ বিলিয়ন ডলার আগের প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে দেওয়া হবে। এ অর্থ ডিজিটাইজেশন, তারল্য সহায়তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবহন খাতে ব্যয় করা হবে।
আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবার সঙ্গে বৈঠকেও নতুন ঋণের আশ্বাস পাওয়া গেছে। বর্তমানে আইএমএফের একটি মিশন বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং এরই মধ্যে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে সংস্থাটি। এখন ড. ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরও ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চায় আইএমএফ। তারা মনে করে, একটি বিশেষ সময়ে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার অনেক খাতে সংস্কার করবে, যা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে।
চীন বাংলাদেশে বড় আকারের সোলার উৎপাদন প্লান্ট স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সোলার প্যানেল উৎপাদন করে সারা বিশ্বে রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাবে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়বে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা দেশের জলবিদ্যুৎ রপ্তানি এবং জ্বালানি খাতে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়াও ইউএসএআইডির প্রধান সামান্তা পাওয়ার এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সিইও মার্ক সুজম্যানও বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার আশ্বাসে বোঝাই যাচ্ছে যে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ সমীহ পাচ্ছে। তবে এই ঋণ সহায়তা পেতে বাংলাদেশকে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। আর্থিক, জ্বালানি, রাজস্ব খাত, এবং ব্যাংকিং নীতিমালাসহ জরুরি সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য একটি সময়োপযোগী কর্মসূচি তৈরি করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে পেশ করতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, এ ঋণগুলো না নিয়ে সরকারের কোনো উপায় ছিল না। দেশের ব্যাংকিং খাত নাজুক অবস্থায় রয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ ঋণগুলো পাওয়া গেলে ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল অবস্থায় আসবে, রিজার্ভ বাড়বে এবং ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে। ফলে দেশের অর্থনীতি পুনরায় স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডলার সংকট কাটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ডলার বিক্রি বন্ধ করে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে ডলারের মজুদ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে এবং রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের কাছাকাছি পৌঁছেছে।